ইয়াছিন রানা সোহেল >>
পার্বত্যাঞ্চল থেকে উঠে আসা ক্রীড়াবিদদের মধ্যে অরুণ চন্দ্র চাকমা অন্যতম। নিজের মেধা ও যোগ্যতায় তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। অর্জন করেছেন অনেক সম্মাননা। জীবনের অধিকাংশটাই কাটিয়েছেন খেলাধূলায়। অনেক দক্ষ খেলোয়াড় তৈরি করেছেন। কিন্তু জীবদ্দশায় বরেণ্য এই ক্রীড়াবিদের কপালে জুটলো না কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। তাঁর মৃত্যুর পরেও হলো না স্মরণ সভা কিংবা শোকসভা। পরিবারের সাথে কথা বলে বরেণ্য এই ক্রীড়াবিদের বর্ণাঢ্য জীবনের নানা দিক।
অরুণ চন্দ্র চাকমা। জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৫ মার্চ পার্বত্য জেলা রাঙামাটি সদর মহকুমার হাজারিবাগ গ্রামে। সাত ভাইবোনের মধ্যে অরুণ ছিল ষষ্ঠ। বাবা সদর হাসপাতালে চাকরি করতেন। বড় ভাই ছিলেন কোলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্র। ফুটবলের প্রতি প্রচ- জোক ছিলো অরুণ চাকমার। সে ভাবতো বড় হয়ে একদিন ভালো একজন ফুটবলার হবে। পরিবারের শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও খেলাধূলা নিয়েই পড়ে থাকতো সে। বড় ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় সে খেলাধূলা করতো। ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর অরুণ চাকমা শেষোবধি হয়েছিলেন খ্যাতিমান অ্যাথলেট।

১৯৫০ সালে রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর টানাপোড়নের সংসারের কারণে কাপ্তাই হাইড্রোলিক প্রজেক্টে কাজ করেছেন দুইবছর। দুইবছর চাকরি শেষে ১৯৫৫ সালে ঢাকাস্থ জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হওয়ার পরেই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধূলায়ও সমানে জড়িয়ে পড়েন। ঢাকার সদরঘাট ব্যাপিস্ট মিশন হোস্টেলেই থাকতেন তিনি।
এখানে এসেই তিনি এ্যাথলেটিক্সকে ভালোবেসে ফেলেন। শক্ত-সামর্থ্য পাহাড়ি তরুনটির ছিল স্পিড। তাই দৌঁড়ের ইভেন্টগুলো তাকে বেশ আকৃষ্ট করেছিল। ১১০মিঃ, ২২০মিঃ স্পিড, হার্ডলসের বাধা পেরুনো তখন কোনো ব্যাপারই না। ফুটবল খেলা যার প্রাণ ছিলো, সে তখন হয়ে গেলো স্প্রিন্টার, হার্ডলার। খেলাধূলায় এতটাই জড়িয়ে পড়েন; পড়ালেখায় তেমন একটা সময় দিতে পারেননি। পড়ালেখায় এগোতে না পারলেও এ্যাথলেটে এগিয়ে গিয়েছেন অনেকদুর।
সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি প্রাদেশিক খেলায় অরুণ চাকমা তাঁর সাফল্য দেখিয়েছেন। যার ফলে ১৯৫৫সালে প্রাদেশিক ক্রীড়া থেকে পূর্ব পাকিস্তান অ্যাথলেট দলের সদস্য হিসেবে বহুবার পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। এত কিছুর পরেও কিন্তু ফুটবল বাদ দিতে পারেননি তিনি। ফলে তিনি ফায়ার সার্ভিস, ইস্পাহানি ও আজাদ স্পোর্টিং দলের পক্ষে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগেও খেলেছিলেন। সেসময় ১৯৫৫,৫৬ ও ৫৭সালে জগন্নাথ কলেজ চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজে এ্যাথলেটিক্স এ চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করেন। ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে তৎকালিন পাকিস্তানের কোচিং সেন্টার এ্যাবোটাবাদে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৬৩ সালে তৎকালিন পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপ প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রাম বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যোগদান করেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের কোচের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের পাতিয়ালায় যান এবং ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় কোচ হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৪ সালে জার্মান সরকার আয়োজিত এশিয়ার এ্যাথলেটিক্স কোচদের জাকার্তায় অনুষ্ঠিত প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে ভারতের পাতিয়ালায় ইন্টারন্যাশনাল অ্যামেসার্স অ্যাথলেটিক ফেডারেশন(আইএএএফ) রিফেসার্স কোর্সে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮০ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত এশিয়া, আফ্রিকা ল্যাটিন আমেরিকা কোচদের ক্রীড়া সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন এবং তুরস্কে ইসলামিক দেশ সমূহের গেমসে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক্স দলের কোচ ও ম্যানেজার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮১সালে ভারতে হরিয়ানা অ্যাথলেটিক্সে-দলের কোচ এবং ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালে মস্কোতে ১ইইএ আফ্রোয়েশিয়ান অলিম্পিক সেমিনারে যোগদান করেন। এখানে ল্যাটিন আমেরিকাসহ ১১০টি দেশ অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৪ সালে প্রথম সাফ গেমসে অ্যাথলেটিক্স দলের কোচ হিসেবে নেপালে গমন করেন এবং এ্যাথলেটিক্স বাংলাদেশ দুটি স্বর্ণপদক লাভ করেন। ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমসে অ্যাথলেথিক্সে স্টাটারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দায়িত্ব পালন ও অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের সুনাম কুড়িয়েছেন। ১৯৮৯ সালে অষ্টম এশিয়ান ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে অফিসিয়াল হিসেবে যোগদান করেন।

১৯৯০ সালে বেইজিংয়ে থার্ড এশিয়ান জুনিয়র মিটে কোচ ও ম্যানেজার হিসেবে মেহেদী ও বিমলকে নিয়ে যাওয়া এবং আয়োজকরা অরুন চন্দ্র চাকমাকে হার্ডেলস বিজয়ীদের পদক দেয়ার সম্মান দেয়। ১৯৯১সালে ৫ম সাফ গেমসে এ্যাথলেটিক্স দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯৩ সালে ঢাকায় সাফ অ্যাথলেটিক্সের প্রধান আরম্ভকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে বহু অ্যাথলেট তৈরি করেছেন এবং অনেক ভালো এ্যাথলেট হয়েছেন।
তাঁর ব্যক্তিগত জীবন অত্যন্ত সহজ ও সরল এবং প্রচারবিমুখ ছিলেন। তিনি আমৃত্যু খেলাধূলা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। জীবন পথের দু’পাশে তাকানোর তাঁর সময় হয়নি। তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে এবং অনেক আত্মীয় স্বজন রেখে গিয়েছেন। তিনি ২০১৫ সালের ১৬ জুন মঙ্গলবার বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর স্ত্রী মুক্তালতা চাকমা জানান, জীবদ্দশায় অরুণ দেশের জন্য অনেক সম্মাননা এনেছেন। দেশের হয়ে অনেক দেশেই গিয়েছেন। এনেছেন সম্মাননা। কিন্তু দেশ তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে মূল্যয়ন করেননি। কোনো সম্মাননা দেননি। তিনি মরণোত্তর হলেও এই গুণী ক্রীড়াবিদকে সম্মাননা দেয়ার অনুরোধ জানান।

