শংকর হোড় ॥
বনভান্তের উদ্দেশে চীবর(ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্র) ও কল্পতরু দানের মাধ্যমে রাঙামাটির রাজবন বিহারে অনুষ্ঠিত হয়েছে দু’দিনব্যাপী ৪৯তম দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব। বৃহস্পতিবার বিকালে বেইনঘর উদ্বোধনের মাধ্যমে শুরু হওয়া মহাউপাসিকা বিশাখা প্রবর্তিত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চীবর তৈরি ও দানের আনুষ্ঠানিকতা শুক্রবার দুপুরে দানের মাধ্যমে শেষ হয়। রাঙামাটির রাজবন বিহারের চীবর দান উৎসবই পার্বত্যাঞ্চলে বৌদ্ধদের বৃহত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব।
শুক্রবার দুপুরে গৌতম বুদ্ধ ও বনভান্তের প্রতিকৃতিতে চীবর দান ও ধর্মীয় দেশনার মাধ্যমে সাঙ্গ হয় এবারের দানোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। এ দিন সন্ধ্যায় হাজার আকাশ প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়। প্রতিবছরের মতো এবারও পাহাড়ের সর্ববৃহৎ চীবরদান উৎসবকে ঘিরে হাজার-হাজার দায়ক-দায়িকা, পুণ্যার্থীর সমাগত ঘটেছে পুরো বিহার এলাকাজুড়ে।
শুক্রবার সকালে বুদ্ধ পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে এই দিনের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হয় দেব-মানবের তথা সকল প্রাণীর হিতার্থে ধর্মদেশনা। ধর্মদেশনায় উপস্থিত ছিলেন রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবির।
সকালে তিন পার্বত্য জেলা থেকে কল্পতরু নিয়ে বিহার প্রাঙ্গণে হাজির হয় হাজার হাজার পুণ্যার্থী। পঞ্চশীল গ্রহণের পর দুপুর আড়াইটায় বনভান্তের মানব প্রতিকৃতির উদ্দেশে কঠিন চীবর উৎসর্গ করা হয়। রাঙামাটি রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবিরের হাতে রাতভর তৈরিকৃত চীবর তুলে দেন সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার। এসময় উপস্থিত ছিলেন রাউজান পাহাড়তলী মহামুনি বৌদ্ধ বিহারে প্রধান উপসংঘরাজ ধর্মপ্রিয় মহাথের, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ, কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক এভভোকেট দীপেন দেওয়ান, উপাসক-উপাসিকা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অমিয় খীসাসহ অন্যান্য পুণ্যার্থীগণ।

চীবরদান অনুষ্ঠানে আসা পূর্ণলতা চাকমা জানান, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা, সুতা থেকে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চীবর তৈরি দান করা হয়। কঠিন পরিশ্রম ও সংকল্পের মাধ্যমে এই দান করা হয় বলে একে কঠিন চীবর দান হিসেবে অভিহিত করা হয়। মূলত দানের মাধ্যমে নিজের অহংকারকে হালকা করা এবং পূণ্য লাভের আশায় এটি করা হয়।
এদিকে উৎসব উপলক্ষে রাজবন বিহার এলাকায় গ্রামীণ মেলা বসেছে। মেলা প্রাঙ্গণে সারাদেশ থেকে কুটির ও হস্তশিল্পের পণ্যের পসরা নিয়ে লোকজন এ মেলায় অংশ নিয়েছে।
উল্লেখ্য, গৌতম বুদ্ধের জীবদ্দশায় মহাউপাসিকা বিশাখা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা এবং সুতা রঙ করে কাপড় বুনে তা সেলাই করে চীবর দান করে এই কঠিন চীবরদানের সূচনা করেন প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। এই পদ্ধতিতে দান করলে কায়িক, বাচনিক মানসিকভাবে অধিক পরিশ্রম হয় এবং অধিকতর পূণ্যলাভ হয় বলে বৌদ্ধ শাস্ত্রে উল্লেখ আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) ১৯৭৪ সালে রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলার তিনটিলা বন বিহারের দায়ক-দায়িকাদের দিয়ে এই কঠিন চীবর দানোৎসবের পুনঃপ্রবর্তন করান।
রাঙামাটি রাজবন বিহারে সর্বপ্রথম কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৬ সালে। সেই থেকে প্রত্যেক বছর রাঙামাটি রাজবন বিহারসহ তিন পার্বত্য জেলার রাজবন বিহারের শাখাসমূহে বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে কঠিন চীবর দানোৎসব সম্পাদন করা হয়ে থাকে।

