-ঞ্যোহ্লা মং
অনেক কলাম লিখেছি। প্রকাশিত কলাম/প্রবন্ধ নিয়ে দুটি বইও প্রকাশ করেছি। তারপরও কিছু আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব দেখা হলে ‘কবি’ সম্বোধন করে কথা বলেন। বলেন “এই কবি এদিকে আয়, কবি তুমিই ভালো বলতে পারবে, কবিকে কাজটা দাও, কিংবা সে কবি মানুষ, ওগুলো পারবে না, বুঝবে না” ইত্যাদি। আমি খেয়াল করে দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিছু ছাত্রছাত্রীরাও আমাকে ‘কবি’ বলে সম্বোধন করে। পরিচিতদের মধ্যে পড়ালেখা জানা মারমা চাকরিজীবিরাও ‘কবি’ বলে ডাকেন। তাদের কি করে বলি যে আমি জীবনে একটা কবিতাও লিখিনি। কবিতা পড়ে বুঝি না বলে পড়িও কম। তবে প্রাইমারি স্কুলে ‘কাজলা দিদি’ পড়ানোর সময়ে ক্লাশে কেঁদেছিলাম। সেদিন বাবাই পড়াচ্ছিলেন বলে আমার খুব মনে আছে। বাবা একই সঙ্গে মারমা ভাষায়ও অনুবাদ করে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন।
এক ভাগিনীর পিরাপিরিতে দুটো মারমা ছড়া লেখার অভিজ্ঞতা আছে। দুটো ছড়া পড়ে তারা যত না মজা পেয়েছে, অন্য কাউকে একটা টু শব্দও করতে শুনিনি। ভাগিনা-ভাগিনীদের মজা পাওয়া দেখে ‘জাক’ থেকে প্রকাশ করলেও মারমা কাউকে আকৃষ্ট করাতে পারিনি। আমার ছড়া লেখার শখ সেখানেই শেষ।
সম্প্রতি আমি বাবাকে হারিয়েছি। বাবার সাথে আমার হাত ধরাধরির সম্পর্ক ছিল। ভালোবাসা, রাগ, অভিমান সবই ছিল। একে অপরকে রাগ দেখিয়ে কথা বন্ধ করার রেকর্ডও ছিল। বাবা মোবাইলে যখন সবে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছিলেন, তখনই কানে কম শুনা শুরু করেন। দূরে বসে বাবার সাথে যোগাযোগ করা এক প্রকার বন্ধই হয়ে যায়। শুধু বাড়িতে গেলেই কথা হতো অন্যান্য খোঁজ খবর নিতে হতো মাধ্যম হয়ে।
বাবা কানে কম শুনায় আমার অনেক ক্ষতি হয়েছে। যে সময়ে আমি পুরোদমে লেখা শুরু করেছি, তখনই তিনি কানে কম শুনতে শুরু করেন। আমার লেখালেখির প্রয়োজনে কত কত তথ্য জানার দরকার ছিল, সে সুযোগ আর পাইনি।
বাবা বেঁচে থাকতেই আমি শ্রমণ হই। তিনি আমাকে দেখে খুশি হয়ে ১২০টাকা দান করেছিলেন। মৃত্যুর তিন-চার ঘন্টা আগেও পাশাপাশি বসে ছবি তুলেছিলাম। শ্রমণ জীবনের কারণে সে রাতে আমাকে বিহারে অবস্থান করতে হয়েছিল। খুব ভোরে বড় ভাই বাবার মৃত্যুর খবর দেন।
ছেলেবেলায় মা শিখিয়েছিলেন দুঃখ-কষ্টের দিনে, শোকের সময়ে কিভাবে নিজেকে ধরে রাখতে হয়। মাকে কোনোদিন কাঁদতে দেখিনি। বাবার মৃত্যুতেও নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু যেদিন শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে, সেদিন সকালে গ্রামবাসী, এলাকাবাসীরা মিলে কফিন বানাতে দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। উঠোনের পূর্ব দিকে চেয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছি। নিজেকে থামাতে চাইলেও পারিনি।
খুব সম্ভবত ১৮ তারিখে একা একা বিহার প্রাঙ্গণে বসে হাতে থাকা কাগজে বাবাকে নিয়ে আমার প্রথম কবিতা লেখার চেষ্টা করি। ঢাকায় ফিরে পরিচিতজনদের “বাঁচি যতদিন” শিরোনামে প্রথম কবিতার লাইন-ঘাট ঠিক করে দিতে বললে, গতানুগতিক মন্তব্যই পেয়েছি “ভালো হয়েছে, চালিয়ে যাও ইত্যাদি”।
বাঁচি যতদিন
-ঞ্যোহ্লা মং
আর কোনোদিন দেখা হবে না জানি
তারপরও কোটি মানুষের ভিড়ে
আনমনে খুঁজতে থাকবো
বাঁচি যতদিন।
নানা কাজের ভিড়ে কোনো কোনোদিন
ভুলে থাকবো, আবার
হঠাৎ কোনো বয়স্ককে দেখে
মনে পড়বেই, বাবা তোমাকে।
বেঁচে থাকতে কত মান-অভিমান
হারিয়ে গেলেই তবে ভুলগুলো ধরা পড়ে।
জানতাম ,তুমি হারিয়ে যাবে
তবে কেন আমরা
উপস্থিতির গুরুত্ব দিতে পারি না!
আর কোনোদিন দেখা হবে না জানি
তারপরও আমি তোমার দেখা,
পাওয়ার বৃথা চেষ্টা করবো।
নির্জনে, নীরবে, একাকী চুপিসারে।
কোনো একদিন তোমার করা পরিচিত শব্দ কানে বাজবেই,
অবচেতন মনে তোমার উপস্থিতি
খুঁজে বেড়াবো।
ঝলমলে কড়া রোদে,
ঝুমঝুম বৃষ্টিতে,
কনকনে শীতের দিনেও,
তোমায় খুঁজবে আমার মন।
কেউ বুঝবে না কেউ টেরও পাবে না
কী খুঁজছি আমি।
পাশে থাকা কেউ
হঠাৎ বলবে কী ভাবছো, কী চিন্তা করছো?
হয়তো কোনোদিন সঠিক উত্তর দেওয়া হবে না।
তোমাকে খুঁজে খুঁজে আমিও
হারিয়ে যাবো, সেদিনও বলা হবে না
আমার মন নীরবে কি খুঁজেছে।
আমার ভালোবাসা নিও বাবা
সম্ভব হলে ছায়া হয়ে দেখা দিও
পারলে মেঘ হয়ে আকাশে কোনোদিন ভেসে দেখিয়ো।
সেদিন আমি খুশি হবো
তোমায় দেখেছি বলে,
তুমি আমায় ভালোবাসো বলে।
বাবাকে নিয়ে পরে আরো “স্বপ্নে না হোক, প্রকৃতি হয়ে এসো” আর “বাবা হারাদের একটি ক্লাব চাই” শিরোনামে দুটি কবিতা লেখার চেষ্টা করি। একটি টাইপ করা হলেও অপরটি আর টাইপ করা হয়নি। খাতাতেই থেকে যায়। কবিতা যে হয়নি, তা মন্তব্য পেয়ে বুঝেছি। আমি কলাম লেখিয়ে হলেও অনেক পরিচিত জন ‘কবি’ সম্বোধন করেন বলে তিনটি কবিতা লেখার চেষ্টা করলাম। কবিতা না হোক, বাবাকে হারানোর পরে বাবাকে নিয়ে আমার চিন্তাগুলো ধরে রেখেছি, তাতেই আমি খুশি। আর হয়তো কবিতা লেখার চেষ্টা হবে না। কবিতা আমার জন্য নয়। চাই গভীর চিন্তা আর ভাষা জ্ঞানের দক্ষতা। আমার তিনটি কবিতাই থাকুক, কবিতা লেখার প্রথম চেষ্টা হিসেবে। বাবাকে নিয়ে কবিতা লেখার চেষ্টা হিসেবে।
স্বপ্নে না হোক
প্রকৃতি হয়ে এসো
-ঞ্যোহ্লা মং
মা জিজ্ঞেস করে
বাবাকে কি দেখেছো?
আমি বলি, না।
বুঝতে পারি
মাও দেখেনি।
বাবা তুমি
তোমার নিকটজনদের কাছে স্বপ্নেও কি আসতে পারো না?
তারা তোমাকে নিয়ে চিন্তা করে।
শুনেছি মা নাকি
প্রতিদিন শ্মশানের পাশে
কালভার্টে বসে থাকে।
বাবা তুমি স্বপ্নে আসতে না পারো,
এক টুকরো বাতাস হয়ে আমাদের গায়ে
হেলান দিয়ে যেও ।
বাতাস হয়ে আসতে না পারো,
বৃষ্টির বড় ফোটা হয়ে এসো।
যেদিন আমরা জানালার পাশে
বসে থাকবো, আমাদের গায়ে ছিটিয়ে যেও।
বৃষ্টির ফোটা হতে না পারো,
বাড়ির উঠোনে ফুলের ওপর
প্রজাপতি হয়ে বেড়াতে এসো।
প্রজাপতি হতে না পারো,
উঠোনে থাকা ফুল গাছের
ফুলগুলোর মাঝে একটি সুন্দর ব্যতিক্রমী ফুল হয়ে এসো।
বাতাস ছাড়া যে ফুলটি দুলবে
আমরা ধরে নিবো সেটিই তু্মি!
ফুল হতে না পারো,
বসন্তের কোকিল হয়ে এসো
যেদিন আমরা সকলে মিলে উঠোনের কোণায়
বসে থাকবো, সেদিন
তোমার মিষ্টি গলায় গান শুনিয়ে যেও।
তোমার নিরাপদ দূরত্ব রেখে গান শুনালে
আমরা ঠিকই বুঝে নিবো, তুমিই এসেছো।
তুমি স্বপ্নে দেখাতে না চাও
প্রকৃতি হয়ে এসো।