শংকর হোড় ॥
চরকায় সুতা কেটে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের চীবর (পরার কাপড়) তৈরি কার্যক্রমের সূচনার মধ্য দিয়ে রাঙামাটির রাজবন বিহারে শুরু হয়েছে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান উৎসব ‘কঠিন চীবর দান’। বৃহস্পতিবার বিকেলে বেইন ঘর উদ্বোধনের মাধ্যমে দুদিনব্যাপী এ উৎসবের উদ্বোধন করেন রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান প্রজ্ঞালংকার মহাস্থবির। উদ্বোধনের পর চরকায় সুতা কেটে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের চীবর (পরার কাপড়) তৈরি কার্যক্রমের সূচনা করেন বিশিষ্ট নারী উদ্যোক্তা মঞ্জুলিকা খীসা। এটি রাজবন বিহারের ৪৯তম কঠিন চীবরদান উৎসব।
এর আগে বেইন ঘরে পঞ্চশীল প্রদান করেন রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান প্রজ্ঞালংকার মহাস্থবির। এ সময় পূণ্যার্থীদের সাধু সাধু ধ্বনিতে মুখরিত হয় পুরো রাজবন বিহার প্রাঙ্গণ। শুক্রবার দুপুরে ভিক্ষু সংঘের কাছে এই চীবর দান করা হবে।
রাজবন বিহারের কার্যকরী কমিটির সূত্রে জানা গেছে, রাজবন বিহারের বিশাল এলাকা জুড়ে প্রায় ২০০টি বেইন স্থাপন করা হয়েছে। এতে প্রায় হাজারখানেক নারী-পুরুষ এই চীবর প্রস্তুত কাজে অংশগ্রহণ করেন। সারা রাতব্যাপী এই চীবর তৈরির কার্যক্রম চলবে।
বৌদ্ধ শাস্ত্র মতে, দীর্ঘ আড়াই হাজার বছর পূর্বে গৌতম বুদ্ধের উপাসিকা বিশাখা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চীবর তৈরির প্রচলন করেছিলেন। তিন মাস বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বর্ষাবাস শেষে আষাড়ী পূর্ণিমা থেকে কার্তিকী পূর্ণিমার মধ্যে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের চীবর দান করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বনভান্তের অনুপ্রেরণায় ১৯৭৬ সাল থেকে বুদ্ধের উপাসিকা বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে রাঙামাটি রাজবন বিহারে কঠিন চীবর দান উৎসব উদযাপিত হয়ে আসছে।
রাজবন বিহারের উপাসক-উপাসিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অমিয় খীসা বলেন, বৌদ্ধ যুগের আদলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চরকায় তুলা থেকে সুতা বের করে তাঁতে বুনে কাপড় তৈরি করা হয়। এই কাপড় বিশেষ কায়দায় সেলাই করে চীবর তৈরি করা হয়। তারপর তা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দান করা হয়। যেকোনো দান বছরের যেকোনো সময় করা যায়। কিন্তু কঠিন চীবরদান করতে হয় আশ্বিনী পূর্ণিমা থেকে কার্তিকী পূর্ণিমার মধ্যে।
কঠিন চীবরদান উৎসবকে ঘিরে তিন পার্বত্য জেলা এবং চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা রাজবন বিহারে এসেছেন। তাঁরা সঙ্গে নিয়ে আসছেন কাঠ ও বাঁশ দিয়ে তৈরি কৃত্রিম গাছে ঝোলানো নগদ টাকা, বই-খাতা, সুঁই-সুতাসহ নানা দানসামগ্রী। এটিকে তাঁরা ‘কল্প তরু’ বলে ডাকে। অনেকে দল বেঁধে বাদ্য বাজিয়ে, বৌদ্ধধর্মীয় সংগীত গেয়ে বিহার প্রাঙ্গণে এসেছেন। রাতব্যাপী বুদ্ধ নাটক, পালা কীর্তন নানান অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয় বিহার প্রাঙ্গণে। দু’দিনের অনুষ্ঠানে লাখো পূণ্যার্থী অংশগ্রহণ করছেন। এই উৎসব ঘিরে বিহার প্রাঙ্গণ জুড়ে গ্রামীণ মেলা বসেছে।
রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জাহেদুল ইসলাম বলেন, আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে। পুরো অনুষ্ঠানে তিন স্তরের নিরাপত্তা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া সাদা পোশাকে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিয়োজিত রয়েছেন। অনুষ্ঠান ঘিরে নাশকতার কোনও আশঙ্কা নেই বলে তিনি জানান।
শুক্রবার দুপুরে বৌদ্ধ সাধকদের চীবর দান এবং সন্ধ্যায় হাজার বাতি উৎসর্গের মাধ্যমে এই উৎসব শেষ হবে।